দেশবাসীর রাগের আঁচ ভালোই টের পাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যুদ্ধ নয় , কূটনীতির অস্ত্রেই পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার ইঙ্গিত কোঝিকোড়ের দলীয় মঞ্চেই স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন৷ কিন্ত্ত ১৮ জন সেনার মৃত্যুর পর দেশবাসীর একটি বড় অংশ চাইছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বদলা৷ কূটনীতির বার্তা যে দেশবাসীর রাগকে বিশেষ প্রশমিত করতে পারছে না , তা বুঝেই রবিবার লালবাহাদুর শাস্ত্রীর ‘জয় জওয়ান , জয় কিষাণ ‘ স্লোগানের আশ্রয় নিলেন মোদি৷ রবিবার ‘মন কি বাত ‘-এ তাঁর ৩৫ মিনিটের বক্তব্যে অবশ্যম্ভাবী ভাবে উঠে এল উরির হামলা , পাকিস্তানকে পাল্টা আক্রমণ এবং কাশ্মীর৷ জানিয়ে দিলেন , যুদ্ধের রাস্তা ধরতে না চাইলেও উরির হানাদারদের শাস্তি দিতে সেনার উপরই ভরসা রাখছেন তিনি৷ এ দিকে , মোদির শনিবারের বক্তব্যের সূত্র ধরেই রবিবার বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে ফের এক বার পাকিস্তানকে বিঁধেছেন তাঁর ডান হাত অমিত শাহ৷ মোদির আক্রমণের জবাব শানাতে অবশ্য এ দিনই ময়দানে নেমে পড়েছে পাকিস্তান৷ ভারতের শীর্ষ নেতৃত্ব ইচ্ছাকৃত ভাবে , উস্কানি দিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন সব অভিযোগ আনছে।
‘মন কি বাত ‘-এর সূচনাতেই মোদি স্পষ্ট করে দেন , ‘সেনাদের হত্যা শুধু তাঁদের পরিবারের ক্ষতি নয় , সমগ্র দেশের ক্ষতি৷ আর তাই , ঘটনার দিন যা বলেছিলাম , আজও তারই পুনরাবৃত্তি করব৷ দোষীরা নিশ্চয়ই শাস্তি পাবে৷ দেশে ক্ষোভ রয়েছে৷ কিন্ত্ত কেউ যুদ্ধ চান না৷ শান্তি আর একতার মধ্যেই দেশের বিকাশ৷ ‘ ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর আস্থা রেখে তাঁর বার্তা, ‘আমরা সাধারণ নাগরিকরা , রাজনীতিকরা অনেক বেশি কথা বলি , কারণ আমাদের কাছে কথা বলার অনেক সুযোগ রয়েছে৷ কিন্ত্ত আমাদের সেনারা বেশি কথা বলেন না৷ সেনাবাহিনী বীরত্বেই জবাব দেয়৷ তাঁরাই আমাদের দেশের গর্ব৷ ‘ এ দিন একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রের লেখা চিঠি পড়েছেন মোদী৷ উরির ঘটনার বিরুদ্ধে কিছু করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে সে৷ নিজের রাগকে ইতিবাচক পথে চালিত করে দেশের জন্যই সে নাকি তিন ঘণ্টা করে বেশি পড়াশোনা করছে৷ এই দৃষ্টান্ত তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর বার্তা, ‘দেশবাসীর এই রাগের মূল্য অনেক৷ দেশ যে জেগে উঠছে , এটা তারই প্রতীক৷ এই রাগটা ‘কিছু করতে হবে ‘ সেই ভাবনার প্রতিফলন … ১৯৬৫ -তে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের সময় , দেশের মনোভাব এমনটাই ছিল৷
দেশজুড়ে এমনই রাগ যে , প্রত্যেকেই জাতীয়তাবাদের জ্বরে আক্রান্ত , প্রত্যেকেই দেশের জন্য কিছু করতে চান৷ সেই সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী৷ তিনি দেশবাসীর এই মনোভাবকে অভিনব ভাবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন৷ সাধারণ মানুষকে দেশের জন্য কাজে উদ্বুদ্ধ করতে ‘জয় জওয়ান , জয় কিষাণ ‘ স্লোগান তুলেছিলেন তিনি৷ ‘ এ প্রসঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর স্বাধীনতার লড়াই এবং তার গঠনমূলক দিকেরও কথা তুলে ধরেছেন মোদি৷ তাঁর প্রতিটি কথায় স্পষ্ট , দেশবাসীর রাগকে সম্মান জানালেও মোটেই যুদ্ধের পথে যেতে চান না তিনি৷ তবে , পাকিস্তানকে চাপে ফেলতে সিন্ধু জলচুক্তি পুনর্বিবেচনা করার কথা আগেই বলেছিল ভারত৷ সে বিষয়ে আলোচনার জন্য আজ একটি বৈঠকে বসতে পারেন মোদি৷ পাকিস্তানকে জল দেওয়া বন্ধ করে দিলে কী কী সমস্যা হতে পারে , তা খতিয়ে দেখবেন তিনি৷ এ দিনও অবশ্য পাকিস্তানকে জবাব দিতে ছাড়েননি মোদি৷ উরির হামলার পর দিন থেকেই পাকিস্তান বিভিন্ন ভাবে কাশ্মীরের পরিস্থিতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে ভারতকে কাঠগড়ায় তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে , রবিবারও যার ব্যতিক্রম হয়নি৷ মোদির স্পষ্ট বার্তা, ‘কাশ্মীরের মানুষ দেশবিরোধী শক্তি বুঝতে আরম্ভ করেছেন৷ বাস্তবটা সামনে আসতেই তাঁরা সেই শক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন৷ তাঁরা শান্তির পথে হাঁটা শুরু করেছেন৷
আমি জানি , তাঁরা শান্তি চান৷ সন্তান যাতে স্কুলে যেতে পারে , তেমন পরিবেশ চান৷ কাশ্মীরে শান্তি বজায় রাখতে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ৷ কাশ্মীরবাসীর নিরাপত্তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমাদের৷ প্রশাসনই সে কাজ করবে৷ ‘ শান্তি , একতা ও সংহতিই উন্নয়নের সহায়ক হবে বলে ভরসা তাঁর৷ এ দিকে , মোদি শনিবার যেখানে শেষ করেছিলেন , সেখান থেকেই শুরু করেছেন অমিত শাহ৷ দলের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকের নান্দীমুখ এ দিন তিনি বেঁধে দিয়েছেন উরির প্রসঙ্গ তুলেই৷ বলেছেন , ‘উরির জঙ্গিহানার মূলচক্রীদের বিরুদ্ধে দেশবাসীর রাগ বিজেপি বোঝে৷ বিজেপি ও কেন্দ্র সরকার শুরু থেকেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে৷ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কড়া জবাবই দেওয়া হবে৷ গত ৮ মাসে ১১৭ জন জঙ্গি মারা পড়েছে৷ জঙ্গিদের অনুপ্রবেশের ছক ১৭ বার সেনারা বানচাল করে দিয়েছে৷ সেই হতাশা থেকেই উরির হামলা৷ এটা একটা দীর্ঘ যুদ্ধ, যা আমাদের প্রতিবেশী আমাদের সঙ্গে চালিয়েই যাচ্ছে৷ উরি তো অন্তর্বর্তী গন্তব্য , চূড়ান্ত ফল নয়৷ চড়ান্ত জয় আমাদেরই হবে৷ ‘ মোদি ও তাঁর সেনাপতির এই হুঙ্কারকে অবশ্য পাকিস্তান পাত্তা দিতে নারাজ৷ শনিবার দলীয় মঞ্চ থেকে পাক জনগণকে পাক সরকারের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করেছিলেন মোদি।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানকে নিঃসঙ্গ করার সব প্রচেষ্টা যে ভারত চালাচ্ছে , তাও স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন৷ এ দিন পাক পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্তা, ‘ভারতীয় নেতৃত্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক মন্তব্য করে , ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে সুপরিকল্পিত ভাবে মিথ্যে প্রচার চালাচ্ছে , এটা দুর্ভাগ্যজনক৷ সর্বোচ্চ রাজনৈতিক স্তরে এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ দুঃখজনক৷ এটা স্পষ্ট , কাশ্মীরে নিরীহ , নিরস্ত্র মানুষের উপর ভারতীয় সেনা যে আক্রমণ শানাচ্ছে , তা থেকে বিশ্ববাসীর নজর ঘোরাতেই ভারতে ইচ্ছাকৃত ভাবে এটা করছে৷ ‘ এ প্রসঙ্গে চর সন্দেহে ধৃত ভারতের নৌসেনা অফিসার কুলভূষণ যাদবের উল্লেখও করেছে পাকিস্তান৷ তাদের দাবি , কূলভূষণের গ্রেন্তারিই প্রমাণ করে , কী ভাবে বালুচিস্তান -সহ পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশে ভারত সন্ত্রাসমূলক কাজকর্মে ইন্ধন জোগাচ্ছে৷ প্রতিবেশী যখন আক্রমণ শানাচ্ছে , তখন কিন্ত্ত সুযোগ ছাড়ছেন না বিরোধীরাও৷ বিএসপি নেত্রী মায়াবতী যেমন বলেই দিয়েছেন , প্রতিবেশীকে জ্ঞান দেওয়ার আগে মোদির উচিত নিজের ঘর সামলানো৷
উন্নয়নের লড়াইয়ে পাকিস্তানকে হারানোর কথা বলেছিলেন মোদি৷ মায়াবতীর কটাক্ষ , ‘পাক প্রধানমন্ত্রীকে জনগণের উন্নয়নের পরামর্শ দেওয়া ভালো , কিন্ত্ত প্রধানমন্ত্রীর উচিত তাঁর নিজের সরকারের কাজকর্মও খতিয়ে দেখা৷ উরির হামলার পর দেশবাসী ক্রুদ্ধ৷ দেশবাসী প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কার্যকর কিছু পদক্ষেপ চান , যাতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না -ঘটে৷ ‘কংগ্রেসের অভিযোগ , শক্ত হাতে সন্ত্রাস দমন করার যে আশ্বাস মোদী ভোটের আগে দিয়েছিলেন , তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি৷ দিগ্বিজয় সিংয়ের কটাক্ষ , ‘মোদির সমর্থকরাও তাঁর এই ভুয়ো আশ্বাস শুনতে শুনতে হতাশ৷ ‘ বিজেপির পক্ষে অবশ্য এর জবাব আসেনি৷ সম্ভবত , প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাগ্যুদ্ধকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বিরোধীদের আপাতত ছাড় দিচ্ছেন মোদি৷ এইসময়
পাঠকের মতামত